মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবদান
সিদ্দিকুর রহমান
কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক
এবং মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থের প্রণেতা।
আমার শ্রদ্ধেয় প্রয়াত শিক্ষক যাঁর কাছে স্কুল জীবনে সত্যিকার অর্থে প্রথম পাঠ পেয়েছিলাম এবং যিনি এক ব্যাখ্যাহীন কারণে আমার প্রতি বিশেষ স্নেহের দৃষ্টি তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিলেন এবং অপার মমত্ববোধে আমাকে ব্যতিক্রমী ধরনের মানুষ বলে বিবেচনা করতেন তিনি হচ্ছেন আলী আকবর মাস্টার। তিনি ছিলেন আমাদের পাশের গ্রামের পাচড়া'র বাসিন্দা। ইংরেজী ভাষা এবং সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ গন্ডিত্য ছিলো। 'আকবর স্যার' ইংরেজী পড়াতেন। কৃতজ্ঞতার সাথে অবশ্যই স্বীকার করবো যে ইংরেজী সাহিত্যের দিকে শৈশব থেকেই আমার যে ঝোঁক এবং আগ্রহ দানা বেঁধে ওঠেছিলো এর পেছনে ছিলো এককভাবে তাঁরই প্রেরণা। তিনি প্রায়ই, এবং যা বলতে কখনো ক্লান্তি কিংবা দ্বিধা বোধ করতেন না, তা হচ্ছে পবিত্র কোরানের একটি বাণী। তিনি এর আরবী আয়াতটি না বলে ইংরেজী অনুবাদের উদ্বৃত উচ্চারণ করতেন। আর বাণীটি হচ্ছে এরকমঃ "THIS WORLD IS THE
CORN FIELD FOR THE NEXT WORLD অর্থাৎ বাংলা অনুবাদে এর মমার্থ যা হয় তা হচ্ছে –এই পৃথিবী হচ্ছে পরকালের শস্যক্ষেত্র। কোরানের এ মহৎ বাণীর শতরকম ব্যাখ্যা হতে পারে। এর পুরো ব্যাখা করা মরণশীল কোনো মানুষের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়।
তারপরেও কথা থেকে যায়। এবং তা হচ্ছে এই যে মানুষ নিজের জ্ঞান ও মেধা অনুযায়ীই ঐশ্বরিক বাণীর অর্থ করতে চায় কিংবা বোঝার চেষ্টা করে। একথাটি যদি কোনো আলোচনার সূত্র বা প্রস্তাবনা হিসেবে মেনে নেয়া যায় তাহলে একটি বিশেষ স্তরে উপনীত হওয়া যায় এবং সেখান থেকে আমরা ভাবতে পারি যে প্রত্যেকটি মুহূর্তের এবং সময়ের একটি নির্ধারিত গুরুত্ব রয়েছে। যাঁরা সময়ের ভাষা বুঝতে পারেন তাদের পক্ষে ভবিষ্যতের বার্তা উপলব্ধি করা সম্ভবপর হয়।
এই প্রসঙ্গে স্মরণ করছি ১৯৫০ সালের একটি ঘটনার কথা তখন আমি আমাদের গ্রাম শংকুচাইলের উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ের ছাত্র। সপ্তম শ্রেণীর। একদিন ভোরবেলা আমাদের একই থানার অর্থাৎ বুড়ীচং-এর অন্তর্গত নাগাইশ গ্রামের ক্যাপ্টেন আবদুল গণি আমাদের স্কুল পরিদর্শনে আসেন। আমরা আগে থেকেই তাঁর নাম জানতাম। সবার মুখে মুখে তাঁর নাম "ক্যাপ্টেন গণি” নামে উচ্চারিত হতো পুরো জেলার কথা জানিনে। তবে তৎকালীন বুড়ীচং থানার (বর্তমানে দু'ভাগে বিভক্ত। বুড়ীচং এবং ব্রাহ্মণপাড়া) তিনি ছিলেন একমাত্র পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। তাছাড়া, তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রিক্রটিং অফিসার। সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগের প্রাথমিক কাজটি তিনি সমাধা করতেন এবং ঐ উদ্দেশ্যে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে তরুণদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
যাহোক, ক্যাপটেন গণিকে আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক তৈয়ব আলী পরিচয় করিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন গণি সম্পর্কে তিনি পরিচয়পর্বে যা বলেছিলেন পুরোপুরি মনে নেই। তবে তার বক্তব্যের যে-কয়েকটি কথা আজো মনে রয়েছে সেসব হচ্ছে এরকমঃ "ক্যাপ্টেন গণি সাহেব আমাদের গৌরব। এমন একটি ধারণার কথা আমরা আজকাল শোনে থাকি যে আমরা বাঙ্গালীরা নাকি সামরিক বাহিনীর জন্যে উপযুক্ত নই। তিনি নিজেই উক্ত ধারণার একটি চলমান প্ৰতিবাদ । ”
ক্যাপ্টেন গণি সামরিক পোষাক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। তিনি দাঁড়ালেন ছেলেরা সবাই প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশাল দেহধারী ক্যাপ্টেন গণি তাঁর ঐতিহাসিক গোঁফে একটু হাত বুলিয়ে সামান্য কাশির শব্দ করলেন। বলে রাখা ভালো, তার কাশি ধ্বনি যেনো তার অসাধারণ ব্যাক্তিত্বকেই প্রকাশ করতো। গৌরবর্ণ চেহারা বড়ো বড়ো আকর্ষক চোখ। ভ্রমর কালো সৈনিক জীবনের কাঠিন্য তার সজীব সুন্দর দু'টি চোখের নিবিড়তা বিনষ্ট করতে পারেনি। সুস্থ সবল কিন্তু পাঞ্জাবীদের মতো পেট -সর্বস্ব নন। অবশ্য, সবার কথা বলছিনে। মাঝারি ধরনের উচ্চতা হচ্ছে তার দৈহিক গঠন। শাল গাছের মতো দৃঢ় এবং সুঠাম। আজ মনে হয়, তার মুখাবয়বের সাথে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়বের কোথাও যেনো, কিছু হলেও, মিল রয়েছে।
যাহোক, ক্যাপ্টেন গণি তার ভাষণে বললেন-BOYS LISTEN TO ME ! তোমরা বয়সে অনেক ছোট্ট। আমি জানিনে, তোমরা আমার কথা বুঝতে পারবে কিনা। তবু কিছু কথা বলতে চাই।
তোমরা হয়তো একেক জন একেকভাবে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছো। কেউ স্বপ্ন দেখছো ব্যারিস্টার হবার। কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সিএসপি, আবার কেউ হয়তো জজ হ’বার – আরো কতো কি। কিন্তু আমি বলতে পারি, তোমাদের মধ্যে হয়তো এমন একজনও নেই যে ছেলে ভবিষ্যতে সৈনিক হ’বার কথা ভাবছো। এটা তোমাদের দোষ নয়। আমরা তোমাদের অভিভাবকেরাই এর জন্যে দায়ী। অবশ্য, প্রসঙ্গতঃ একটু বিষয়ান্তরে যাবো। সত্যিকার অর্থে আমরা তোমাদের চোখের সামনে-এক্ষেত্রে আমি শিক্ষকদের কথাও বলছি-জীবনে বড়ো কিছু হওয়ার মনোভাব ও আদর্শ তোলে ধরতে পারিনি। আমাদের শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য কী আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনি। যা হোক, আমি একজন সোলজার এবং এ বিষয়েই আমি কথা বলাবো। [কাঁশির ধ্বনি করে গোঁফে একটু হাত বুলিয়ে নেন] আমি বলতে চাই, এদেশকে গড়ে তুলতে হলে, ছোটবেলা থেকেই সবাইকে সামরিক শিক্ষা দিতে হবে। AND THAT SHOULD BE A PART
OF OUR EDUCATION POLICY. কথাটির অর্থ বাংলায় বলছিঃ সামরিক শিক্ষা আমাদের শিক্ষানীতির একটি অংশ হওয়া উচিত। এর ফলে দেহ ও মন দু'টিই ভালো থাকবে। আমরা নাকি NON-MARTIAL RACE! এই অপবাদ থেকে রেহাই পাবো। দেশরক্ষার জন্যে একমাত্র সামরিক শিক্ষা ছাড়া আর কোনো শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। আমার পাশে তৈয়ব আলী সাহেব বসে আছেন। তিনি আমাকে শৈশব থেকেই জানেন। আমি যখন সামরিক বাহিনীতে যাই তখন আমার আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং মুরুব্বীরা আমাকে নিরস্ত করতে চেয়েছেন। আমি কারো কথা শুনিনি। আমি আর্মিতে জয়েন করি। তখন মুরুব্বীরা বলেছিলেন- “দেখ গণি! সৈন্য অইলে গুলী খাইয়া মরণ লাগে। আর্মিতে যাইসনা।” আমি আর্মিতেই গেলাম। কমিশন পেলাম। এদেশের বহু তরুণকে আমি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ করেছি। আমি মনে করি, শুধু নিজের জন্যে বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। যদি মরতে হয়, মরতে তো হবেই একদিন, দেশের জন্যে গুলী খেয়ে মরার চেয়ে বড়ো আর কিছু নেই। আরো একটা কথা বলি, যারা আমাকে ভয় দেখিয়েছেন তাদের অনেকেই ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর,
কলেরা, বসন্তে মারা গেছেন।
আল্লাহর রহমতে আমি আজো বেঁচে আছি। আরো একটি কথা। আমি দেশের শত শত যুবককে সেনাবাহিনীতে বিশেষতঃ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়ে কোনো ভুল করেছি কিনা ভবিষ্যতই তা বলে দেবে। তোমাদের জন্যে আমার শেষ কথা হচ্ছে, তোমরা তোমাদের জীবনের লক্ষ্যে অন্যান্য বিষয়ের সাথে সেনাবাহিনীর কথাও মনে রাখবে। “THANK YOU MY
BOYS!";
না। তিনি ভুল করেননি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনিকদের BENGAL,
TIGERS বলা হয়। এবং ওরাই স্বাধীনতা যুদ্ধকালে 'বঙ্গ শার্দুল' নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি যে স্বপ্নের বীজ রোপন করেছিলেন এর বিকাশ এবং পরিণতি ঘটেছিলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে।
আরো একটি ঐতিহাসিক বিষয়ের উল্লেখ করা না হলে বর্তমান আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আইয়ুব খান যখন সেনাবাহিনী প্রধান কিংবা সেনাবাহিনীর নীতি নির্ধারকদের পর্যায়ে অবস্থান করছিলেন তখন এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন 'AT LEAST FOR GREATER UNITY, URDU HAS TO BE
THE OFFICIAL LANGUAGE OF THE SOLDIERS! আবদুল গণি তৎক্ষনাত এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন- 'NO!
BEN- GALI SHALL BE THE OFFICIAL LANGUAGE OF THE BENGAL REGIMENT SOL-
DIERS."
আইয়ুব খান তখন এই অবিশ্বাস্য আচরণের জন্যে ক্ষুদ্ধ হয়ে আবদুল গণিকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজকের সময়ে কারো পক্ষে হয়তো কল্পনা করাও সম্ভব হবেনা কী করে এবং কতোটা পরিমাণে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হলে একজন ক্যাপ্টেন র্যাংক-এর অফিসার এক জেনারেলের মুখোমুখি প্রতিবাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন এবং কী করেই বা তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গোড়াপত্তনে অন্যতম বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মেজর গণি তাই ছিলেন। আর এ কারণেই তিনি বাঙ্গালী সৈনিক এবং জনগণের কাছে অতো প্রিয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্য- তম কর্ণধার আতাউল গণি ওসমানী ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন এর কর্ণেল কমানডেন্ট। জিয়াউর রহমান, শহীদ রাষ্ট্রপতিও ছিলেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন রণাঙ্গণের সেক্টর এবং সাক-সেক্টর কমান্ডারদের একটি বিরাট অংশ ছিলেন ওই রেজিমেন্টের অন্তভূক্ত সৈনিক।
প্রতিটি রণাঙ্গনে সাহসে শৌর্যে বুদ্ধিমত্তায় রণকৌশলে নেতৃত্বে সংগঠনে বীরত্বে তেঁজে গরিমায়ে প্রতিরোধে প্রতিশোধ এবং তৎপরতায় বঙ্গশার্দুলদের কাহিনী যদি একত্র সন্নিবেশিত করা যেতো তাহলে আমাদের সৈনিকদের মরণজয়ী সংগ্রামের ইতিহাস স্পষ্টাক্ষরে একথা প্রমাণ করে দিতে পারতো সে বাঙ্গালীরা আবেগপ্রবণ জাতি হলেও সমরে শিবিরে আত্মপ্রত্যয় প্রতিষ্ঠায় শুধু যে MARTIAL RACE তাও নয় তারা হচ্ছে বিশ্বের অনন্য এক দেশ প্রেমিক সামরিক শক্তির উদ্ভাবক এবং প্রেরণার উৎস।
এক বন্ধু বলেছিলেন –
SOLDIERS OF THE EAST BENGAL REGIMENT SHALL PERPETU - ATE THE MEMORY OF MAJOR
GHONI. বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের মাধ্যমেই তাঁর স্মৃতি চির জাগরুক থাকবে।
সামারিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের পক্ষেই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা এবং অবদানের ইতিহাস সম্পর্কে কোনো কিছু নির্ভূলভাবে লেখা সম্ভবপর। কাজেই, আমার এ লেখাটি উক্ত বিষয়ের একটি ভূমিকা ছাড়া অন্য কিছু মনে করার কোনো সুযোগ নেই। এবং এ হচ্ছে মহৎপ্রাণ মানুষটির প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধের এক লিপিবদ্ধ উচ্চারণ মাত্র একই সঙ্গে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযুদ্ধকালীন সৈনিকদের জন্যেও।
সিদ্দিকুর রহমান
কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক
এবং মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থের প্রণেতা।